সাগর রায়ঃ গোলাকৃতির এই পৃথিবীর ধ্রুব সত্য হলো, ‘কোনো কিছুই চিরস্থায়ী নয়’। বহু গুণীজন এই কথা বলেছেন অসংখ্যবার। যত কীর্তিমানই না হোন না কেন, একটা জায়গায় গিয়ে সবাইকেই থামতে হয়। সেখানে ব্যতিক্রম নয় এই জগতের ক্রীড়া বিশ্বও। বরং ধ্রুব সত্যি এই বাণী আরও আগে ধরা দেয় এখানে। একটা মানুষের ৩০-৩৫ বছরে যেখানে কাজ করা শুরু হয়, অথচ সেখানে খেলোয়াড়দের শেষের শুরু হয়। ফুটবলের কথাই ধরা যাক। বয়সের কোটা ৩০ পার করলেই, বাতিলের তালিকাতে নাম উঠে যায়। দম আর ক্ষিপ্রতার খেলাটিতে পিছিয়ে পড়েন বেশিরভাগই। যারা ৩৫’র উপর পর্যন্ত চালাতে পারেন, তাদের ভাগ্যবানই বলা যায় নিঃসন্দেহে!
স্বাভাবিক খেলা যেখানে অনিশ্চয়তায়, সেখানে বিশ্বকাপের মতো আসর তো অধরাই। একটা বয়সের পর সবারই বিশ্বকাপ ভাগ্য শেষ হয়ে যায়। প্রতিটা বিশ্বকাপেই এরকম অনেক ফুটবলার থাকেন, যাদের পরবর্তী বিশ্বকাপে খেলার সম্ভাবনা নেই একদম। অনেকে আবার ঘোষণা দিয়ে বলে দেন সেই কথা। তেমনই কাতারে হতে যাওয়া ২০২২ ফুটবল বিশ্বকাপে একটা বড় অধ্যায়ের সমাপ্তি হতে চলেছে। ফুটবল দুনিয়ার সেরা মঞ্চের এবারের আসরে একটা সোনালি প্রজন্মের ইতি ঘটতে চলেছে। তারকাদের শেষ পদচিহ্ন পড়তে যাচ্ছে।
বর্তমান ফুটবল বিশ্বের তথা, পুরো ফুটবল ইতিহাসের দুই মহাতারকা লিওনেল মেসি ও ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোর শেষ বিশ্বকাপ হতে চলেছে এটি। শুধু তাদেরই নয়, আরেক সুপারস্টার নেইমার জুনিয়রেরও শেষ বিশ্বকাপ হওয়ার জোরালো সম্ভাবনা। তালিকায় আছেন ম্যানুয়েল ন্যয়ার, হুগো লরিস, থিয়াগো সিলভা, দানি আলভেস, সার্জিও বুসকেটস, লুকা মদ্রিচ, অ্যাঞ্জেল ডি মারিয়া, থমাস মুলার, করিম বেনজেমা, লুইস সুয়ারেজ, রবার্ট লেভানডফস্কির মতো তারকারা।
ম্যানুয়েল ন্যয়ার
জার্মানির ইতিহাসের অন্যতম সেরা গোলরক্ষক ম্যানুয়েল ন্যয়ার। ৩৬ বছর বয়সে এসেও দাপটের সঙ্গে খেলে যাচ্ছেন ক্লাব ও জাতীয় দলে। অনেক তরুণ ফুটবলারও এই তারকার সাথে টেক্কা দিতে পারবেন না। ২০১৪ সালে জার্মানিকে ফুটবল বিশ্বকাপ জেতাতে ভূমিকা রেখেছেন তিনি। গোল পোস্টের নিচে অতন্দ্র এই প্রহরী সেই বিশ্বকাপে সেরা গোলরক্ষকও নির্বাচিত হয়েছিলেন। ২০০৯ সালে আন্তর্জাতিক ফুটবলে অভিষেকের পর থেকে ৩টি বিশ্বকাপই খেলেছেন ন্যয়ার। এবার কাতারে হতে যাওয়া আসর তার জন্য চতুর্থ বিশ্বকাপ। একইসাথে শেষ বিশ্বকাপও।
হুগো লরিস
কাতারে হতে যাওয়া বিশ্বকাপে অন্যতম অভিজ্ঞ গোলরক্ষক লরিস। টটেনহ্যাম হটস্পারের এই গোলরক্ষক বর্তমান বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ফ্রান্সের অধিনায়ক। ফ্রান্সের গোলবার অক্ষত রাখার পাশাপাশি রেকর্ড গড়েছেন সর্বোচ্চ সংখ্যক ম্যাচে জাতীয় দলকে নেতৃত্ব দিয়ে। তবে ক্যারিয়ারের সবচেয়ে বড় সাফল্য বিশ্বকাপ শিরোপাজয়ী অধিনায়কের তালিকায় তার নাম। ৩৫ বছর বয়সী এই ফুটবলার, এবারও অধিনায়ক হয়ে যাচ্ছেন কাতারে বিশ্বকাপ খেলতে। ন্যয়ারের মতো তারও ক্যারিয়ারের চতুর্থ আর শেষ বিশ্বকাপ হতে চলেছে।
দানি আলভেস
কাগজে-কলমে ব্রাজিলের এই তারকা ফুটবলারের বয়স ৩৯। তবে এই ডিফেন্ডার খেলতে যাচ্ছেন বিশ্বকাপে। কাতারে হতে যাওয়া আসরে সবচেয়ে বয়স্ক ফুটবলার তিনি। স্বীকৃত ফুটবলে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক ট্রফি জয়ীর মালিক খেলবেন ক্যারিয়ারের চতুর্থ বিশ্বকাপ। তবে এই রাইট ব্যাকের এটিই হতে যাচ্ছে ক্যারিয়ারের শেষ বিশ্বকাপ।
থিয়াগো সিলভা
ব্রাজিলের অন্যতম তারকা ফুটবলার সিলভা। ছিলেন অধিনায়কও। তবে বর্তমানে ডিফেন্সে অন্যতম ভরসা হয়েই মাঠ মাতাচ্ছেন তিনি। ৩৮ বছর বয়সী এই ফুটবলার কাতারে খেলতে যাচ্ছেন নিজের চতুর্থ ও শেষ বিশ্বকাপ। এর মধ্যে ২০১০ বিশ্বকাপ দলে থাকলেও, একটি ম্যাচও খেলা হয়নি। পরবর্তীতে ঘরের মাঠে ২০১৪ সালে খেলেছেন বিশ্বকাপে নিজেদের অভিষেক ম্যাচ।
সার্জিও বুসকেটস
বার্সেলোনার মিডফিল্ডার বুসকেটস এবারের বিশ্বকাপে স্পেন দলের অধিনায়ক। ২০১০ সালে দক্ষিণ আফ্রিকায় হওয়া আসর ছিল তার ক্যারিয়ারের প্রথম বিশ্বকাপ। আর নিজের অভিষেক আসরেই চ্যাম্পিয়ন শিরোপার স্বাদ পান তিনি। সেই বিশ্বকাপে প্রথমবারের মতো চ্যাম্পিয়ন হয় স্পেন। এবারের কাতার বিশ্বকাপ হতে যাচ্ছে বুসকেটসের শেষ বিশ্বকাপ।
লুকা মদ্রিচ
বিশ্বকাপ ফুটবলের খুব একটা বড় নাম ছিল না ক্রোয়েশিয়া। তবে সব জায়ান্টদের জন্য আতঙ্ক হয়ে দাঁড়িয়েছিল ২০১৮ সালের আসরে। রাশিয়ায় অনুষ্ঠিত আসরে সেবার রানার্সআপ হয়েছিল ক্রোয়াটরা। যার মূল কারিগর লুকা মদ্রিচ। শিরোপা জিততে না পারলেও আসরের সেরা খেলোয়াড় হয়েছিলেন। পরবর্তীতে ব্যালন ডি অরও জিতেছিলেন। ২০০৬ সালে ক্যারিয়ারের প্রথম বিশ্বকাপ খেলেছিলেন। তবে ২০১০ সালে তার দল কোয়ালিফাই করতে ব্যর্থ হওয়ায়, তারও খেলা হয়নি। পরবর্তীতে অবশ্য ২০১৪ বিশ্বকাপে খেলেছেন। সেই ৩৭ বছর বয়সী মদ্রিচ এবার ক্যারিয়ারের চতুর্থ ও শেষ বিশ্বকাপ খেলতে যাচ্ছেন কাতারে।
অ্যাঞ্জেল ডি মারিয়া
আর্জেন্টিনার এই অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার আগেভাগে অবসরের ঘোষণা দিয়েই বিশ্বকাপে খেলতে যাচ্ছেন। ৩৪ বছর বয়সী এই তারকার উপর বিশেষ নজর থাকবে এবার আলবিসেলেস্তে সমর্থকদের। কেননা মেসির মতো তাকেও জ্বলে উঠতে হবে, যদি বিশ্বকাপ জিততে হয়। অবশ্য ফর্মে থাকা এই ফুটবলার ক্যারিয়ারের শেষ বিশ্বকাপ রাঙাতে নিজের সেরাটা উজাড় করে খেলবেন, সেই নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। ২০১০ বিশ্বকাপে প্রথমবার খেলার পর, কাতারে হতে যাওয়া আসর তার চতুর্থ বিশ্বকাপ হতে চলেছে। যেটি কিনা তার শেষ বিশ্বকাপও।
করিম বেনজেমা
ক্লাবের হয়ে দারুণ ফর্মে আছেন করিম বেনজেমা। কিছুদিন আগেই জিতেছেন ব্যালন ডি’অর। অবশ্য খানিকটা চোটের সমস্যায় ভুগছেন তিনি। ফ্রান্সের ৩৪ বছর বয়সী এই ফুটবলার কাতারে খেলতে যাবেন ক্যারিয়ারের মাত্র দ্বিতীয় বিশ্বকাপ। অথচ ২০০৭ সালে আন্তর্জাতিক ফুটবলে অভিষেক রিয়াল মাদ্রিদ ফরোয়ার্ডের। ২০১০ ও ২০১৮ বিশ্বকাপ খেলা হয়নি। ২০১৪ বিশ্বকাপে প্রথমবার নাম লেখান। এবার ২০২২ সালে ক্যারিয়ারের শেষ বিশ্বকাপ খেলবেন।
থমাস মুলার
সব ঠিক থাকলে এবার ক্যারিয়ারের শেষ বিশ্বকাপ খেলতে যাচ্ছেন থমাস মুলার। ৩৩ বছর বয়সী এই ফুটবলারের আন্তর্জাতিক অঙ্গনে অভিষেক হয়েছিল ২০১০ সালে। আর সেবছরই দক্ষিণ আফ্রিকায় হওয়া বিশ্বকাপে খেলেন তিনি। পরবর্তীতে ২০১৪ বিশ্বকাপজয়ী দলের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ছিলেন। এছাড়া খেলেছেন ২০১৮ রাশিয়া বিশ্বকাপেও। যদি বড় কোনো চমক না থাকে আগামী বিশ্বকাপে, তবে এবার তিনি ক্যারিয়ারের চতুর্থ ও শেষ বিশ্বকাপ খেলতে যাচ্ছেন কাতারে।
রবার্ট লেভানডফস্কি
বিশ্বকাপে পোল্যান্ড খুব একটা সামর্থ্যবান দল নয়। তবে দলে আছেন বিশ্বমানের খেলোয়াড় রবার্ট লেভানডফস্কি। আর তাই তাদেরকেও এখন আর হালকাভাবে নেওয়া হয় না। ৩৪ বছর বয়সী এই ফরোয়ার্ডের এটিই হতে যাচ্ছে ক্যারিয়ারের শেষ বিশ্বকাপ। এর আগে ক্যারিয়ারে কেবল একটি মাত্র বিশ্বকাপ খেলেছেন, আর সেটা ২০১৮ সালে।
লুইস সুয়ারেজ
উরুগুরুয়ের এই তারকা ফুটবলার ক্যারিয়ারের একেবারে গৌধুলি লগ্নে আছেন। ৩৫ বছর বয়সী এই ফরোয়ার্ডের ক্যারিয়ারের শেষ বিশ্বকাপ এটি। ২০১০ সালে নিজের প্রথম বিশ্বকাপ খেলেছিলেন। সেই আসরে কোয়ার্টার ফাইনালে যাওয়ার ম্যাচে শেষ মূহুর্তে ঘানার বিপক্ষে গোলবারে হাত দিয়ে বল আটকে লাল কার্ড দেখেন। ঘানা পেনাল্টি পেলেও, গোল করতে না পারেনি। এরপর ২০১৪ বিশ্বকাপে ইতালির বিপক্ষে কিয়েল্লিনির কাঁধে কামড় বসিয়ে আবার বিতর্কের তৈরি করেন। এরপর ২০১৮ বিশ্বকাপে খেলেন। এবার খেলতে যাচ্ছেন ক্যারিয়ারের চতুর্থ বিশ্বকাপ।
নেইমার জুনিয়র
বিশ্বকাপ শুরুর আগে কয়েকবার নিজের অবসর প্রসঙ্গে ইঙ্গিত দিয়েছেন নেইমার। সবশেষও তিনি জানান, এবারের বিশ্বকাপ হতে পারে তার শেষ বিশ্বকাপ। আগামী বিশ্বকাপে খেলা হবে কিনা, নিশ্চিত নন তিনি। দর্শক ও সাবেক তারকাদের প্রবল চাপের পরও নেইমারকে ২০১০ বিশ্বকাপ দলে নেওয়া হয়নি। পরবর্তীতে ২০১৪ সালে নেইমার নিজের প্রথম বিশ্বকাপ খেলেন, সেটা একজন দলের মূল তারকা হয়ে। যদিও ঘরের মাঠে বিশ্বকাপ চলাকালীন গুরুতর ইনজুরিতে পড়তে হয় তাঁকে। ব্রাজিলিয়ান সুপারস্টার পরবর্তীতে ২০১৮ বিশ্বকাপেও খেলেছেন। এবার আরও একটি বিশ্বকাপ খেলতে যাচ্ছেন। বয়স ৩০ আর প্রতিভা থাকায় অনায়াসেই আরও একটি বিশ্বকাপ খেলার সুযোগ রয়েছে। তবে এই তারকা ফরোয়ার্ডের যাত্রা থেমে যেতে পারে কাতার বিশ্বকাপেই।
ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো
বর্তমান বিশ্বের সেরা দুই খেলোয়াড়ের একজন ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো। বিশ্বকাপের মঞ্চে এবারই শেষ বারের মতো মাঠ মাতাবেন এই কিংবদন্তি। পর্তুগিজ মহাতারকা নিশ্চিতভাবেই চাইবেন নিজের শেষ বিশ্বকাপ রাঙাতে। ৩৭ বছরের রোনালদোর ক্যারিয়ারে এটি তার পঞ্চম বিশ্বকাপ হতে চলেছে। অসংখ্য রেকর্ডের মালিক সিআরসেভেনের দিকে চেয়ে আছেন বিশ্বের কোটি কোটি সমর্থক। অনেক সমর্থক ট্রফি জয়ের স্বপ্ন বুনছেন রোনালদোকে ঘিরে। এই তারকা পর্তুগালকে প্রথমবার বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন করতে পারেন কিনা সেটি সময়ই বলে দিবে। তবে বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ারে বিশ্বকাপে আর খেলা হবে না, সেটি এক প্রকার নিশ্চিতই।
লিওনেল মেসি
ফুটবল বিশ্বের জাদুকর মেসি। সমর্থকরা আবার কেউ কেউ ডাকেন ভিনগ্রহের ফুটবলার বলেও। সেই মহাতারকা এবারই খেলতে যাচ্ছেন শেষ বিশ্বকাপ। আগেভাগেই ঘোষণা দিয়ে ক্যারিয়ারের শেষ বিশ্বকাপে খেলতে যাচ্ছেন এলএমটেন। বিশ্বের কোটি কোটি আর্জেন্টাইন ভক্ত চেয়ে আছে তাঁর দিকে, ক্যারিয়ারের শেষটা শিরোপায় রাঙাবেন। কেননা ক্যারিয়ারে অসংখ্য প্রাপ্তির মধ্যে শুধুমাত্র এই বিশ্বকাপই নেই তাঁর। উড়ন্ত ফর্মে থাকা মেসির হাত ধরে আর্জেন্টিনার শিরোপা খরা কাটবে সেই প্রত্যাশাও সকলের। এই সুপারস্টার নিজেও যে মনেপ্রাণে চাইছেন বিষয়টি, সেটি সকলের জানা। যদিও পঞ্চম বিশ্বকাপ খেলতে যাওয়া এই তারকার সেরা সুযোগ ছিল ২০১৪ ব্রাজিল বিশ্বকাপে। সেবার ফাইনালে গিয়ে অতিরিক্ত সময়ের শেষ দিকে শিরোপা স্বপ্নের ইতি টানতে হয়েছে আর্জেন্টিনাকে। বিশ্বসেরার মঞ্চে মেসিকে শিরোপা হাতে দেখতে চায় তাই সকলেই। ক্যারিয়ারের শেষ বিশ্বকাপ কাতার কী নিয়ে অপেক্ষা করছে তার জন্য, সেটিই দেখার পালা এবার।
এসএনপিস্পোর্টসটোয়েন্টিফোরডটকম/নিপ্র/সা/00