নিজস্ব প্রতিবেদকঃ মুস্তাফিজের বলে তার হাতেই ক্রিস ওকসের ক্যাচ। ‘কাটার মাস্টার’ খ্যাত এই পেসারের সিরিজজুড়ে প্রথম উইকেট ও সব মিলিয়ে সিরিজের শেষ উইকেট, আর এতেই বুনোউল্লাস বাংলাদেশের। কেননা অবশেষে আসলো কাঙ্খিত সেই জয়। প্রথম ওয়ানডেতে হয়েও হয়নি। দ্বিতীয় ওয়ানডেতে বাজে পারফম্যান্স।
সিরিজ হার নিশ্চিত হলেও, হোয়াইটওয়াশ এড়িয়ে মান বাঁচানোর লক্ষ্য ছিল সোমবার। ঘরের মাঠে নিজেদের প্রিয় ফরম্যাটে অবশেষে সেই মান রক্ষা হয়েছে টাইগারদের। একইসাথে দলের ড্রেসিং রুমে স্বস্তির নিঃশ্বাস। সিরিজের তৃতীয় এবং শেষ ওয়ানডেতে ইংল্যান্ডকে ৫০ রানের ব্যবধানে হারিয়েছে বাংলাদেশ। সিরিজ শেষ হয়েছে ২-১ ব্যবধানে। বাংলাদেশের দেওয়া ২৪৭ রানের লক্ষ্যে ব্যাট করতে নেমে ইংলিশরা গুঁটিয়ে গেছে ১৯৬ রানেই।
ব্যাট হাতে ৭৫ রান করা পর বল হাতেও ৪ উইকেট শিকার করে অলরাউন্ডিং নৈপুণ্য দেখিয়েছেন দেশের সুপারস্টার সাকিব আল হাসান। সাকিব ছাড়াও দারুণ বোলিং করেছেন এবাদত হোসেন। এর আগে ব্যাট হাতে মুশফিকুর রহিম ও নাজমুল হোসেন শান্ত অবদান রাখেন ফিফটি হাঁকিয়ে।
বাংলাদেশের দেওয়া ২৪৭ রানের লক্ষ্যে ব্যাট করতে নেমে শুরুটা বেশ ভালোই করেছিল ইংল্যান্ড। তবে হুট করে সাকিব আল হাসানের স্পিন ঘূর্ণির সাথে এবাদত হোসেনের পেসে বিপাকে পড়ে সফরকারীরা। টানা তিন ওভারে টপ অর্ডারের তিন উইকেট হারিয়ে বসে। দারুণ শুরু পাওয়া ইংল্যান্ড দলের উদ্বোধনী জুটি ভাঙেন সাকিব। নবম ওভারের শেষ বলে আক্রমণাত্বক হওয়া ফিল সল্টকে কাভারে থাকা মাহমুদউল্লাহ রিয়াদের তালুবন্দি করেন। ৫৪ রানের উদ্বোধনী জুটি ভেঙে সল্ট ফিরেন ২৫ বলে ৭ বাউন্ডারিতে ৩৫ রান করে।
পরের ওভারেই সদ্য উইকেটে আসা ডেভিড মালানকে ফেরান এবাদত। ওভারের পঞ্চমে এবাদতের বলে সেই মাহমুদউল্লাহর হাতেই মিড অনে ক্যাচ তুলে দেন মালান, ফিরে যান ডাক মেরে। পরের ওভার, অর্থাৎ ১১তম ওভারের প্রথম বলেই জেসন রয়কে বোল্ডআউট করেন সাকিব। সাকিবের দ্বিতীয় শিকারে পরিণত হওয়ার আগে ৩৩ বলে ৩ বাউন্ডারিতে ১৯ রান করেন আগের ম্যাচেই সেঞ্চুরি হাঁকানো জেসন।
এক রানের ব্যবধানে ৩ উইকেট হারিয়ে বিপর্যয়ে পড়া ইংল্যান্ড দল এরপর ব্যাটিংয়ে দিয়েছে চমক। ব্যাটিং অর্ডারে উন্নতি করে স্যাম কারানকে পাঁচে নামিয়েছে ইংলিশরা। যার সুফলও পেয়েছে দলটি। ক্রমেই ভয়ঙ্কর হয়ে উঠছিল ইংল্যান্ডের চতুর্থ উইকেটে গড়া জেমস ভিন্স ও স্যাম কারানের জুটি। ৪৯ রানের সেই জুটি ভাঙেন অবশেষে মিরাজ।
২৪তম ওভারের তৃতীয় বলে কারানকে ফেরান মিরাজ। মিরাজের স্পিন ফাঁদে পড়ে উড়িয়ে মারতে গিয়ে লং অফে লিটন দাসের হাতে ক্যাচ তুলে দিতে বাধ্য হন এই বাঁহাতি। ফিরে যান ৪৯ বলে ১টি করে বাউন্ডারি ও ছয়ের মারে ২৩ রান করে। এরপর বাটলার ও ভিন্স মিলে ২৩ রানের জুটি গড়তেই সেটি ভেঙে দেন সাকিব।
নিজের তৃতীয় শিকারে ভিন্সকে ফিরিয়ে ম্যাচ জমিয়ে তুলেন বাংলাদেশের সুপারস্টার। ২৭তম ওভারের পঞ্চম বলে উইকেটের পেছনে মুশফিকের রহিমের ক্যাচে ভিন্সকে পরিণত করেন সাকিব। এই বাঁহাতির গতিময় ঘূর্ণিতে বল বুঝতেই পারেননি ভিন্স। মিডল স্টাম্প থেকে বল টার্ন করে ব্যাটের কানায় লেগে চলে যায় উইকেটের পেছনে মুশফিকের কাছে। দুই বারের চেষ্টায় সেটি লুফে নেন অভিজ্ঞ মুশি। এক প্রান্ত আগলে রাখা ভিন্স ৪৪ বলে তিন বাউন্ডারি ও এক ছক্কায় ৩৮ রান করেন।
ভিন্সের বিদায়ে উইকেটে আসেন মঈন আলি। তবে তিনি টিকতে পারেননি বেশি সময়। পরের ওভারেই এবাদতের বলে বোল্ড আউট হয়ে প্যাভিলিয়নে ফেরেন। এবাদতের ঘন্টায় ১৪৩ কিলোমিটার গতির হাফ-ভলি বলে ফ্লিক করতে ব্যর্থ হলে, স্টাম্পে আঘাত হানে। মাত্র ২ রান করেই ড্রেসিং রুমের পথ ধরেছেন মঈন। এই তারকার বিদায়ে ইংল্যান্ডের বিপদ বাড়ে।
সেখান থেকে অধিনায়ক বাটলার ও ক্রিস ওকস জুটি গড়েন। ২৮ রানের সেই জুটি ভয় ধরাতে যখন যাচ্ছিল, তখনই ভেঙে দেন তাইজুল ইসলাম। এলবিডব্লিউর ফেলেন বাটলারকে। রিভিউ নিয়েও বাঁচতে না পেরে ২৬ রানেই প্যাভিলিয়নে ফেরেন এই তারকা। এতেই জয় অনেকটা নিশ্চিত হয়ে যায় বাংলাদেশের। শেষ দিকে ওকস একাই লড়াই চালান। ২ বাউন্ডারিতে তার ৩৪ রানের ইনিংস কেবল পরাজয়ের ব্যবধানই কমায়। অপরপ্রান্তে আদিল রশিদ, রেহান আহমেদ, জোফ্রা আর্চাররা অল্প সময় সঙ্গ দিয়েছিলেন। তবে দুইশ’র আগেই গুঁটিয়ে গেছে সফরকারীদের ইনিংস।
বাংলাদেশের হয়ে সাকিব একাই ১০ ওভারে ৩৫ রান দিয়ে শিকার করেছেন ৪ উইকেট। অল্পের জন্য পূরণ করতে পারেননি ৫ উইকেট। এর বাইরে ৯ ওভারে ১ মেইডেনসহ ৩৮ রান খরচায় ২ উইকেট শিকার করে দারুণ বোলিং করেন এবাদত। এর বাইরে তাইজুলও ২টি উইকেট নিয়েছেন।
এর আগে চট্টগ্রামের জহুর আহমেদ চৌধুরি স্টেডিয়ামে টস জিতে ব্যাট করতে নেমে ৪৮.৫ ওভারে ২৪৬ রানে অলআউট হয় বাংলাদেশ। আরও একবার পুরো ৫০ ওভার খেলতে ব্যর্থ স্বাগতিকরা। বাংলাদেশের ইনিংসের শুরুটা ছিল একেবারে বাজে। প্রথম ওভারেই দলীয় এক রানের মাথায় প্যাভিলিয়নের পথ ধরেন ওপেনার লিটন দাস। টানা দ্বিতীয় ম্যাচে ডাক মেরেছেন তিনি। আর সেই দুই ম্যাচেই আউট হয়েছেন স্যাম কারানের বলে। এই সিরিজে পুরোপুরি ব্যর্থ লিটন, যথাক্রমে ৭, ০, ০ রান করেছেন।
ভালো শুরু পেয়েও সুবিধা করতে পারেননি অধিনায়ক তামিম ইকবাল। ইনিংসের তৃতীয় ওভারের শেষ বলে দলীয় ১৭ রানের মাথায় প্যাভিলিয়নে ফেরেন চট্টলার ঘরের ছেলে। স্যাম কারানের দ্বিতীয় শিকার হয়েই ড্রেসিং রুমের পথ ধরেন তিনি। ৬ বলে ১ বাউন্ডারিতে করে যান ১১ রান। এরপরই ইনিংসের হাল ধরেন শান্ত ও মুশফিক। পাওয়ার প্লে’তে দুই উইকেট হারিয়ে মাত্র ৩৪ রান আসে দলের। ১০ ওভার বা ৬০ বলের মধ্যে ৪৩টিই ডট খেলে বাংলাদেশ।
তবে দুজনের অবিচ্ছিন্ন জুটিতেই বেশ ভালোভাবে এগিয়ে চলছিল বাংলাদেশ। তাদের জুটি যখন একশ রানের কাছাকাছি, তখন ভুল বোঝাবুঝিতে রান আউট হয়ে ফিরে যান শান্ত। ২৫তম ওভারের তৃতীয় বলে দলীয় ১১৫ আর জুটির রান ৯৮’র সময় আউট হন এই বাঁহাতি। এর আগেই অবশ্য ব্যক্তিগত ফিফটি পূরণ করেন শান্ত। এই সিরিজে ও ওয়ানডে ক্যারিয়ারে নিজের দ্বিতীয় ফিফটি হাঁকিয়ে তিনি ফেরেন ৫৩ রানে। ৭১ বলে ৫ বাউন্ডারিতে সাজান নিজের ইনিংস।
শান্তর বিদায়ে উইকেটে আসেন সাকিব আল হাসান। অপরদিকে ফিফটি পূরণ করেন মুশফিকুর রহিমও। ৭ ম্যাচ আর ৭ মাস পর ওয়ানডেতে নিজের ৪৩তম ফিফটি পূরণ করেন রান খরায় ভুগতে থাকা মিস্টার ডিপেন্ডেবল। গেল বছরের আগস্টে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে সবশেষ পঞ্চাশোর্ধ ইনিংস খেলেন। ফিফটি পূরণ করে বেশ ভালোভাবেই এগোচ্ছিলেন। সেঞ্চুরি হাঁকানোর আশাও জাগিয়েছিলেন। তবে শেষ পর্যন্ত আর পারেননি।
মুশফিক ফিরেছেন ৭০ রান করে। ৯৩ বলে ৬ বাউন্ডারিতে সাজিয়েছেন নিজের ইনিংস। ৩৩তম ওভারে গিয়ে সাকিবের সাথে তাঁর ৩৮ রানের জুটি ভাঙে আদিল রশিদের বলে সুইপ শট খেলতে গিয়ে বোল্ড আউট হয়ে ফিরলে। উইকেটে এসে দ্রুতই বিদায় নেন মাহমুদউল্লাহ রিয়াদও। ছক্কা হাঁকিয়ে ভালো কিছুর ইঙ্গিত দিলেও, থেমেছেন মাত্র ৮ রান করে। যে আদিল রশিদকে ছক্কা হাঁকিয়েছিলেন, তার বলেই বোল্ডআউট হয়ে ৩৫তম ওভারে ফিরেছেন। সুযোগ পেয়েও কাজে লাগাতে ব্যর্থ হন আরও একবার।
ফের বিপর্যয়ে পড়া বাংলাদেশের ঢাল হয়ে তখন দাঁড়ান সাকিব। তাঁকে ভালোভাবেই সঙ্গ দিচ্ছিলেন উইকেটে আসা আফিফ হোসেন ধ্রুব। এক প্রান্ত আগলে রেখে ক্যারিয়ারের ৫২তম ওয়ানডে আর ইংলিশদের বিপক্ষে টানা দুই ম্যাচে ফিফটি তুলেন বাংলাদেশের সুপারস্টার সাকিব। কিন্তু ৪৪তম ওভারের প্রথম বলে নিজের ফিফটি পূরণ করেন সাকিব, আর আফিফ ফিরেছেন সেই ওভারের চতুর্থ বলেই। ক্রিস ওকসের বলে কাভারে খেলতে গিয়ে মঈন আলির হাতে ক্যাচ তুলে দেন তিনি। এই বাঁহাতি করেছেন ২৪ বলে ২ বাউন্ডারিতে করেন মাত্র ১৫ রান।
অথচ বড় রান করার আর বাংলাদেশের বিপদের মুখে লড়ে যাওয়ার সঠিক সময় পেয়েছিলেন আফিফ। গুরুত্বপূর্ণ সময় ৪৯ রানে জুটি ভাঙার পর বড় রানের আশা মিটে যায়। দ্রুতই ফিরেন মেহেদী হাসান মিরাজও। ৪৫তম ওভারের পঞ্চম বলে বাউন্ডারি হাঁকিয়েছেন। আর আদিল রশিদের ওভারের শেষ বলে তার হাতেই ক্যাচ তুলে ড্রেসিং রুমের পথ ধরেন। এক বাউন্ডারিতে ৬ বলে ৫ রান করে যান। তাইজুল ফিরেন ২ রান করে।
একা হয়ে পড়া সাকিব বড় রানের আশায় শেষ দিকে ঝড় তোলার চেষ্টা করেন। আর্চারের করা ৪৯তম ওভারের চতুর্থ বলে লং অনে জেসন রয়ের দুর্দান্ত ক্যাচে আউট হওয়ার আগে তিনি খেলেন ৭৫ রানের ইনিংস। দলের পক্ষে সর্বোচ্চ রানের সেই ইনিংসটি সাজানো ছিল ৭ বাউন্ডারিতে। সাকিবের বিদায়ের পর উইকেটে এসে মুস্তাফিজুর রহমান গোল্ডেন ডাক মারলে, আড়াইশ পূরণের আগেই গুঁটিয়ে যায় বাংলাদেশের ইনিংস।
ইংল্যান্ডের হয়ে জোর্ফ্রা আর্চার একাই ৩ উইকেট শিকার করেন। স্যাম কারান ও আদিল রশিদ ২টি করে উইকেট লাভ করেন।
এসএনপিস্পোর্টসটোয়েন্টিফোরডটকম/নিপ্র/সা
Discussion about this post