সিলেটের হয়ে বিপিএল খেলতে চান বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত রবিন দাস

0
56

সাগর রায়: লর্ডসে চলছিল ইংল্যান্ড ও নিউজিল্যান্ডের মধ্যকার প্রথম টেস্টের প্রথম দিনের খেলা। টস জিতে ব্যাট করতে নামা নিউজিল্যান্ড দল তখন ধুঁকছিল। ইংলিশ পেসারদের তোপে কিউইদের দিশেহারা হওয়ার অবস্থা তখন উপভোগ করছিল সবাই। এরই মাঝে ইনিংসের ৩৮.২ ওভারে হঠাৎই টিভি স্ক্রিনে ভেসে উঠে এক তরুণের ইংল্যান্ড দলের জার্সিতে মাঠে প্রবেশের দৃশ্য। মূহুর্তেই সবার মনে প্রশ্ন কে এই তরুণ? ইংলিশ স্কোয়াডে তো দেখা যায়নি এর আগে!

সেই তরুণের নাম-পরিচয় পরিষ্কার হয় ম্যাচের ধারাভাষ্যকারের কন্ঠে, ‘রবিন দাস, ইংল্যান্ডের ১২তম সদস্য হিসেবে ফিল্ডিং করতে নেমেছেন মাঠে।’ তখন পর্যন্তও বাংলাদেশের ক্রিকেট অনুরাগীদের বড় একটা অংশ রবিন দাসের আসল পরিচয় জানেন না। কিন্তু বিষয়টি সর্বপ্রথম খোলামেলা হয়, স্বপ্নীল দত্ত নামের একজন নিজেদের মামাতো ভাই রবিনকে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ক্রিকেটার হিসেবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পরিচয় করে দেন।

মূহুর্তেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয় বিষয়টি। অবশ্য হবেই বা কেন! বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত একজন ক্রিকেটার বেন স্টোকস – জো রুটদের মতো ক্রিকেটারদের সাথে এক কাতারে ফিল্ডিংয়ে নেমেছে, সেটাও আবার ক্রিকেটের তীর্থস্থান খ্যাত লর্ডসে। এতো আর চাট্টিখানি কথা নয়!

ম্যাচের যে সময়টাতে রবিন মাঠে নামেন, তখন ইংলিশ ক্রিকেটার ম্যাথিউ পটস নিজের অভিষেক ম্যাচ খেলতে নেমে চোটে পড়েন। দারুণ বল করতে থাকা এই পেসার বোলিংয়ের সময় চোটে পড়ে মাঠ ছাড়েন বাধ্য হয়েই। আর তখনই বদলি হিসেবে মাঠে নামেন রবিন। আগের দিন যেখানে ১৩ জনের দল দেওয়া হলো, সেখানে ১২তম ফিল্ডার হিসেবে রবিনকে নামতে হলো কেন?

সেটারও কারণ আছে। মূলত পটসের আগে মূল একাদশের আরও দুই জন মাঠের বাইরে চলে গিয়েছিলেন। তাই বদলি হিসেবে আগেই ফিল্ডিং করতে নামতে হয়েছিল একাদশের বাইরে থাকা দুই অতিরিক্ত ক্রিকেটার হ্যারি ব্রুক ও ক্রেইগ ওভারটনকে। তৃতীয় ফিল্ডারের প্রয়োজন পড়লেও, মূলত স্কোয়াডের কেউ ছিলেন না। আর তাই অতিরিক্ত সদস্য হিসেবে থাকা রবিনকে মাঠে নামানো হয়েছে ফিল্ডিংয়ের জন্য।

অবশ্য মাত্র ৪ বল ফিল্ডিং করতে পেরেছেন তিনি। পটসের করা ওভারের বাকি চার বল পূরণ করেন অধিনায়ক হিসেবে অভিষেক হওয়া স্টোকস। আর সেই ওভার পূরণ হওয়ার পর মাঠ থেকে তুলে নেওয়া হয় রবিনকে। পুনরায় মাঠে ফিরেন স্টুয়ার্ট ব্রড। লর্ডসে এর আগেও দুই বার খেলেছেন রবিন।

তবে এই চার বল ফিল্ডিং করেই বাংলাদেশের ক্রিকেট পাড়ায় আলোড়ন তুলেছেন রবিন। বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ক্রিকেটার হওয়ায় তার সম্পর্কে জানার আগ্রহ ঘিরে ধরেছে সকলকেই। মূলত রবিনের জন্ম ইংল্যান্ডে। ২০০২ সালে ২৭ ফেব্রুয়ারি ইংল্যান্ডের লেটনস্টোনে জন্মগ্রহণ করেন রবিন। তার পৈত্রিক নিবাস সুনামগঞ্জ জেলার ছাতকে।

রবিনের বাবা মৃদুল কান্তি দাস ১৯৮৯ সালে জীবিকার উদ্দেশ্যে পাড়ি জমান ইংল্যান্ডে। এরপর সেখানেই স্থায়ী হন। মৃদুল দাসের দ্বিতীয় ছেলে রবিন দাস। বাবা ও বড় ভাই জোনাথন জয় দাসের দেখানো পথে ছোট থেকেই ক্রিকেটের প্রতি বেশ অনুরাগী ছিলেন রবিন। ইংল্যান্ডের কাউন্টি ক্রিকেটের দল এসেক্সের ক্লাবে ব্যাটার হিসেবে খেলেন তিনি। বয়সভিত্তিক পর্যায় থেকে পারফর্ম করতে করতে এখন এসেক্সের মূল দলেও জায়গা করে নিয়েছেন।

২০১৮ সালে সর্বপ্রথম আলোচনায় আসেন রবিন। ক্ষুদে এই ক্রিকেটার এসেক্সের অনূর্ধ্ব-১৬ পর্যায়ের ক্লাব ক্রিকেটে রেকর্ডময় এক ডাবল সেঞ্চুরি হাঁকান। ১৫ বছর বয়সে সেই টুর্নামেন্টের কোয়ার্টার ফাইনালে ব্রেন্টউডের বিপক্ষে ওয়ানস্টিড ক্লাবের হয়ে ওপেনিংয়ে নেমে মারমুখী ব্যাটিংয়ে ডাবল সেঞ্চুরির দারুণ এক ইনিংস খেলেন। সে বছরই মৌসুমজুড়ে ব্যাট হাতে দারুণ পারফর্মের জন্য এসেক্স একাডেমির সেরা খেলোয়াড় এবং সেরা তরুণ ক্রিকেটারের পুরষ্কার জিতেন।

বয়সভিত্তিক পর্যায়ে রবিনের আছে আরও একটি ডাবল সেঞ্চুরি। অনূর্ধ্ব-১৮ পর্যায়ের ক্রিকেটে এসেক্সের হয়ে ডাবল সেঞ্চুরি হাঁকান তিনি। আর সেটা হাঁকান কেন্টের বিপক্ষে। বয়সভিত্তিক পর্যায়েই বিখ্যাত লর্ডসে দুই বার খেলেছেন রবিন। মাত্র ১৬ বছর বয়সে ওয়ানস্টিড ক্লাবের হয়ে ক্রিকেট আইন প্রণেতা সংস্থা মেরিলেবন ক্রিকেট ক্লাবের (এমসিসি) বিপক্ষে মাঠে নামেন। আর সেই ম্যাচে হাঁকান হাফ-সেঞ্চুরিও। এছাড়া ইংল্যান্ড অনূর্ধ্ব-১৬ দলের হয়েও খেলেন এই লর্ডসের মাঠে। তাই লর্ডস নতুন কিছু না তার জন্য।

বয়সভিত্তিক পর্যায় মাড়িয়ে, রবিন জায়গা করেন এসেক্সের দ্বিতীয় একাদশে। যেখানে নিয়মিত খেলেন তিনি। গেল ২০২০ সালে ক্যারিয়ারের সবচেয়ে বড় ম্যাচ খেলার সুযোগ পান রবিন। ১৮ বছর বয়সে এসেক্সের মূল দলে প্রথমবারের মতো খেলার সুযোগ হয়। আর সেটাও আবার ইংল্যান্ডের জনপ্রিয় টি-টোয়েন্টি টুর্নামেন্ট ভাইটালিটি টি-টোয়েন্টি ব্লাস্টে।

স্বীকৃত ক্রিকেটে নিজের অভিষেক ম্যাচটি রবিন খেলেন আরেক বিখ্যাত ক্লাব সাসেক্সের বিপক্ষে। সেই দলের অধিনায়ক ছিলেন তারকা ক্রিকেটার লুক রাইট। এছাড়া রবি বোপারা, ডেভিড ভিসে, ফিল সল্ট, ওলি রবিনসন, টাইমাল মিলসদের মতো ক্রিকেটাররা ছিলেন বিপক্ষ দলের একাদশে।

তবে এখন পর্যন্ত কাউন্টি ক্রিকেটে খেলার সৌভাগ্য হয়নি রবিনের। ২০ বছর বয়সী এই ক্রিকেটার কাউন্টি ক্রিকেটের প্রথম ডিভিশনে খেলা এসেক্সের হয়ে অভিষেকের অপেক্ষায় আছেন। তবে বর্তমানে কাউন্টির মূল দলের স্কোয়াডে যুক্ত আছেন। এবারের মৌসুমে বড় দৈর্ঘ্যের ক্রিকেটে এসেক্সের দ্বিতীয় একাদশের হয়ে ২ সেঞ্চুরি ও ৪টি হাফ-সেঞ্চুরি হাঁকিয়েছেন। আর সেই দুর্দান্ত ফর্মই রবিনকে কাউন্টিতে অভিষেকের জন্য আত্মবিশ্বাসী করে তুলেছে। বলা যায় খুব বেশি দূরে নয় সেই সুযোগ!

অভিষেক না হলেও, ইতিমধ্যেই ইংলিশ কিংবদন্তী স্যার অ্যালিস্টার কুকের সাথে ড্রেসিং রুম ভাগাভাগি করেছেন রবিন। এসেক্সের মূল দলের হয়ে এখনও কাউন্টি ক্রিকেট খেলে যাচ্ছেন ইংল্যান্ডের সাবেক অধিনায়ক কুক। নিঃসন্দেহে এক তরুণের জন্য বড় প্রাপ্তি এমন ব্যাটারকে কাছে দেখা এবং শেখা। এছাড়া ইংল্যান্ডের জাতীয় দলে খেলা ড্যান লরেন্স, দক্ষিণ আফ্রিকার তারকা স্পিন অলরাউন্ডার সিমন হারমার আছেন মূল দলে। তাদের কাছে থাকার সুযোগ হচ্ছে সবসময়ই। একজন তরুণ ক্রিকেটারের জন্য যা কিনা অনেক বড় প্রাপ্তি।

অ্যালিস্টার কুক ও সিমন হার্মারের সাথে মধ্যমণি পুরষ্কার হাতে থাকা রবিন দাস।

রবিনের পরিবারের সাথে কথা বলে জানা গেছে, বাংলাদেশেও খেলার ইচ্ছে আছে তার। বঙ্গবন্ধু কাপ টি-টোয়েন্টিসহ বিপিএলেও প্লেয়ার্স ড্রাফটে নাম নিবন্ধন করেছিলেন রবিন। তবে কেউই তাকে দলে নেয়নি। এখনই আশা ছাড়ছে না রবিন ও রবিনের পরিবার। তাদের ইচ্ছে আগামী বিপিএলে দল পাওয়ার। সেজন্য চেষ্টাও চালিয়ে যাচ্ছেন তারা।

বিশেষ করে পরিবারের চাওয়া অনুযায়ী সিলেটের ফ্র্যাঞ্চাইজির হয়ে বিপিএল মাতাতে চান রবিন। যেটা কিনা গর্বিত করবে তার এবং তার পরিবারকে। যদিও ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেটে আবেগের সুযোগ নেই, তবুও নিজ পৈত্রিক নিবাসের হয়ে খেলতে চাওয়া অমূলক কিছুও নয়। বাংলাদেশের ক্রিকেটকে নিয়মিতই অনুসরণ করেন রবিন। বিশেষ করে সাকিব আল হাসান ও তামিম ইকবালের অনেক বড় ভক্ত তিনি। খুব ইচ্ছে বাংলাদেশে ক্রিকেট খেলবেন। এর আগে শৈশবে একবার বাংলাদেশে ভ্রমণ করে গিয়েছিলেন রবিন।

তবে বাংলাদেশ জাতীয় দলে খেলার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে! ইতিমধ্যেই এসেক্সের স্থানীয় ক্রিকেটার হিসেবে নিবন্ধিত হয়ে গেছেন। আর একজন একইসাথে দুই দেশে স্থানীয় ক্রিকেটার হিসেবে খেলতে পারেন না। যদি কখনো বিপিএলে সুযোগ মেলেও, তবে বিদেশী ক্যাটাগরিতেই খেলতে হবে।

আর জাতীয় দলের প্রশ্নে ইংল্যান্ডই হবে মূল উত্তর! পরিবারের আশা একদিন ইংল্যান্ড জাতীয় দলের হয়ে খেলবেন রবিন। ঐতিহ্যবাহী লর্ডসে স্টোকস-রুট-অ্যান্ডারসনদের সাথে অন্যরকম অভিষেকের পর সেই আশার পালে বড় হাওয়া লেগেছে। সব মিলিয়ে রবিনের এখন পর্যন্ত অর্জনে গর্বিত তার পরিবার।

এসএনপিস্পোর্টসকে  রবিনের বড় ভাই জোনাথন জয় দাস বলেন, ‘আমি এবং আমার পরিবার খুবই খুশি ও গর্বিত। লর্ডসের মতো জায়গা সব ক্রিকেটারেরই স্বপ্নের মতো। তবে এর আগেও দুই বার সেখানে খেলেছে সে। এবার অনেক অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পারবে (জাতীয়) দলের সাথে থেকে। আর কাছ থেকে বিশ্বের সেরা খেলোয়াড়দের উপভোগ করতে পারছে। একইসাথে শিখতেও পারছে কীভাবে তারা খেলছে। সেই খুবই কঠোর অনুশীলন করে। ক্রিকেটে সাফল্য পেতে খুবই দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।’

রবিনের বড় ভাই জোনাথন জয় দাসও একজন ক্রিকেটার। তিনিও এসেক্সের হয়ে খেলেছেন। এসেক্সের দ্বিতীয় একাদশে উইকেটরক্ষক ব্যাটার হিসেবে ছিলেন। তার বাংলাদেশে খেলারও অভিজ্ঞতা রয়েছে। ২০০৮-০৯ মৌসুমে সিলেট বিভাগীয় পর্যায়ে অনূর্ধ্ব-১৬ ক্রিকেট প্রতিযোগীতায় সুনামগঞ্জ জেলা অনূর্ধ্ব-১৬ দলের হয়ে খেলেছেন জয়। এছাড়া ২০১২ সালে খেলেছেন অনির্বাণ ক্রীড়া চক্রের হয়ে সিলেটের প্রথম বিভাগ ক্রিকেট লিগেও খেলেছেন।

এদিকে উচ্ছ্বসিত বাংলাদেশে থাকা রবিনের স্থানীয় পরিবারও। এসএনপিস্পোর্টসকে রবিনের কাকা (ছোট চাচা) মৃন্ময় দাস বলেন, ‘আমরা খুবই আনন্দিত। সে ইংল্যান্ড দলের হয়ে মাঠে নেমেছে, এটা খুবই গর্বের। পরিবার-প্রতিবেশী সবাই খোঁজখবর নিচ্ছে, বিষয়টি জানার পর।’

এসএনপিস্পোর্টসটোয়েন্টিফোরডটকম/নিপ্র/সা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here