সুরমা থেকে বিশ্ব ফুটবলে… : মো. ফয়সাল আহমদ

0
125

১৯ আগস্ট ২০১৫। সিলেটের জেলা স্টেডিয়মে হাজারো দর্শকের উন্মাদনা। সিলেটের মাঠে ফুটবলে দক্ষিণ এশিয়ার কিশোরদের শ্রেষ্ঠত্বের লড়াইয়ে মাঠে নেমেছে ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন ভারত ও স্বাগতিক বাংলাদশে। কিন্তু, টান টান উত্তেজনাপুর্ণ ম্যাচটির ফলাফল গোল শুন্য ড্র। এবার টাইব্রেকার।

১১ জনের লড়াই থেকে এবার লড়াই দুই জনের। একজনের লক্ষ্য গোল ঠেকানো আর অপরজনের লক্ষ্য জালে বল ঢোকানো।

বাংলাদেশের পোস্টে শেষ শট। গোল হলে আবার টাই আর ঠেকালে বাংলাদেশ বিজয়ী।  গোলবারের দিকে একরাশ আশা নিয়ে তাকিয়ে আছে হাজারো দর্শক, বড় বড় টিভি ক্যামেরা গুলোও তাক করা আছে গোলপোস্টে। কয়েক হাজার দর্শকের চাপ সামলিয়ে সেই টাইব্রেকারে ভারতের শেষ শটটি ঠেকিয়ে দিলো বাংলাদেশ সাফ অনুর্ধ্ব-১৬ ফুটবল দলের গোলকিপার সুনামগঞ্জের ছেলে ফয়সল।

কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই উৎসবে মাতলো স্টেডিয়াম ভর্তি হাজারো দর্শক। উতসব শুরু হলো সারা দেশে। কোটি বাঙালী ফুটবল প্রেমী মেতে উঠলনে উৎসবে। ইতিহাসে প্রথমবারের মত সাফ অনুর্ধ্ব -১৬ তে চ্যাম্পিয়ন হলো বাংলাদেশ।

সাফ অনুর্ধ্ব-১৬ তে বাংলাদেশকে শিরোপা এনে দেওয়া সেই ফয়সল অনুশীলন করে এসেছেন ম্যানচেস্টার ইউইনাইটেডেও।

যার এই অসাধারণ গোল সেইভে সেদিন অন্ধকার কালো রাতে বর্ণিল উৎসব করেছিলো বাঙালী ফুটবল প্রেমীরা সেই ফয়ছলই এসএনপিস্পোর্টসটোয়েন্টিফোরডটকম’র নতুনদের কলামে ৩য় পর্বে লিখছেন আজ ।

তার বেড়ে ওঠার গল্প, আগামীর স্বপ্নকে নিয়েই আজকের আয়োজন।

সিলেটের সুনামগঞ্জ জেলার উত্তর আরফিন নগর গ্রামের মো. কিরণ মিয়া ও সাফিয়া বেগমের ছেলে বাংলাদেশ জাতীয় অনুর্ধ্ব-১৬ ফুটবল দলের গোলকিপার, ক্যানরিওয়ার্ফ ফুটবল একাডেমি ইউকের খেলোয়াড় মো. ফয়ছল আহমদ।

মো. ফয়সাল আহমদ: সুনামগঞ্জের সুরমা পাড়েই আমার বাড়ি। উত্তর আরফিন নগর গ্রামেই ছোট থেকে বেড়ে উঠছি। সুরমা নদীর পারেই ফুটবলের হাতে-খড়ি। আমার স্বপ্ন ছিলো একদিন বড় ফুটবলার হবো। সুরমার পার থেকে নিজেকে নিয়ে যাব বিশ্ব ফুটবলের মঞ্চে। সব সময়ই এই একটাই স্বপ্ন দেখে আসছি। যখন জাতীয় অনুর্ধ্ব-১৬ ফুটবল দলে খেলি তখনি স্বপ্নের পরিধিটা বেড়ে যায়। যখন আমরা প্রথমবারের মত সাফ কিশোরদের চ্যাম্পিয়ন হই সিলেটের মাঠে তখন থেকেই স্বপ্নটা আরো বিস্তৃতি লাভ করে। আজ স্বপ্

ন দেখছি আমি একদিন লাল-সবুজের জাতীয় দলে খেলবো। সুরমার পারের ছেলে বিশ^ ফুটবলের মঞ্চে যাবো।

সবাই চায় ফুটবলের মাঝ মাঠে দাপিয়ে বেড়াতে। প্রতিপক্ষের জালে বল জড়াতে। স্বপ্ন আমিও দেখতাম। তবে ছোট ছিলাম বলে এলাকার বড় ভাইরা আমাকে দলেই নিতো না। আমি প্রতিদিন এলাকার মাঠে গিয়ে বড়দের খেলা দেখেছি। অভাব-অনঠনের সংসার আমাদের। পরিবার থেকে ফুটবলার হওয়ার জন্য সাপোর্ট পেলেও আর্থিক সহযোগিতাটা ছিলই না। নিজের অদম্য ইচ্ছা আর শক্তিকে কাজে লাগিয়ে খেলা শুরু করি।

গর্বিত মা-বাবার সাথে ফয়ছল

গর্বিত মা-বাবার সাথে ফয়ছল

প্রথম প্রথম যখন ফুটবল খেলতে যেতাম এলাকার বড় ভাইরা দলে নিতো একটা শর্তে। ‘অবহেলিত’ গোলপোস্টে বসতে হতো আমাকে। আমিও রাজি হতাম। সেই যাত্রা দিয়েই গোলপোস্টে আমার খেলা শুরু। আমার ফুটবলটা শুরুই গোলপোষ্টের প্রহরী হয়ে।  গ্রামে-গঞ্জে এখনো ফুটবল খেলায় অবহেলিত থাকে গোলবার। কেউই গোলবারে থাকতে চায় না। সবাই চায় সামনে খেলতে। বল নিয়ে লড়াই করতে। আমি সেটাই বেছে নিয়ে ছিলাম। গোলবারে আমাকে বসিয়ে রাখা যেত অনায়াসেই। সে জন্যই বড় ভাইরা আমাকে দলে নিতেন। কিন্তুু ধীরে ধীরে আমি তাদের ভরসার প্রতীক হতে থাকলাম। গোলপোষ্টে বল আসলে মণ-প্রাণ দিয়ে চাইতাম সেটি রুখ দেওয়ার। সে থেকে আমার পরিচয়টা গোলকিপার হিসেবেই।

 

সুনামগঞ্জের সেই গোলবারের ছোট্ট ফয়সল আজ পেশাদার গোলকিপার। আমার ফুটবল জীবনটা ছোটকাল থেকেই শুরু হয়েছিল নিজের পাড়া গাঁয়ে। তবে সেটার বিস্তৃতি ছড়িয়ে ছিলো ২০০৯ সালের দিকে। সুনামগঞ্জ জেলা অনুর্ধ্ব- ১৩ ফুটবল দলের  হয়ে আমি তখন বাফুফের বয়স ভিত্তিক টুর্ণামেন্টে অংশ গ্রহণ করি। সেবার নারায়ণগঞ্জ জেলার সাথে আমরা ফাইনালে হেরে রানার্সআপ হয়েছি। তারপর ২০১০ সালে অনুর্ধ্ব-১৪ দলের হয়ে খেলি। পরের বছরও একই দলের হয়ে খেলি।

২০১২ সালের মাঝামাঝিতে প্রথম বারের মত আয়োজিত এয়ারটেল রাইজিং র্স্টাসের প্রতিযোগিতায় অংশ গ্রহণ করি। প্রথমে আমার নিজ জেলা সুনামগঞ্জে বাছাইয়ে আমি উর্ত্তীণ হই। তারপর বিভাগীয় বাছাইয়েও আমি সিলেট বিভাগে ঠিকে যাই। সারাদেশে প্রায় ৬০ হাজার ফুটবলার অংশ নিয়ে ছিলো। ভাবতেই পারিনি এত হাজার জনের ভীড়ে আমি ঠিকে যাবো। বিভাগীয় পর্যায়ে প্রায় ২৫ জনের মত করে বাছাই করা হয়েছিলো। বিভাগীয় পর্যায়ে উত্তীর্ণদেরকে নিয়ে বিকেএসপিতে মূল বাছাই শুরু হলো। এত হাজার হজার জন থেকে বাছাই করে মাত্র ১২ জনকে নেওয়া হলো মূল দলে। সেখানে আমি থাকবো এমন আত্মবিশ্বাস ছিলো আমার মনে। বিকেএসপিতে শেষ মুহুর্তের বাছাইয়েও আমি ঠিকে যাই ১২ জনে।

তারপর স্বপ্নের মতো শুরু। এয়ারটেলের হয়ে স্বপ্নের ম্যান চেস্টর ইউনাইটেড ক্লাবে যাওয়ার স্বপ্নে বিভোর আমি। ২০১২ সালে ১৭ নভেম্বর আমি এয়ারটেল রাইজিং স্টারর্সের হয়ে ইংল্যান্ডে ম্যান চেস্টার ইউনাইটেড ক্লাবে সাত দিনের অনুশীলন ক্যাম্প করতে যাই। ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের গোলকিপার দিগিয়া, ব্রাজিলের তারকা ডিফেন্ডার রাফায়েল, নেদার ল্যান্ডের রবিন ভেন ফার্সির মতো বিশ্বমানের তারকাদের কাছে পেয়ে যেনো বিশ্বাসই হচ্ছিলো না। তাদের কাছে পেয়ে এগিয়ে যাওয়ার অনুপ্রেরণটা শুরু হলো।

ইংল্যান্ডের ওল্ড ট্রাফোর্ড এর বিখ্যাত স্যার এলেক্স ফার্গুসন স্টেডিয়ামে স্বপ্নের মধ্যেই কেটে যায় অনুশীলনের একটি সপ্তাহ।

এরপর আমি ক্যানারিওয়ার্ফ ইউকে বাংলাদেশ ফুটবল একাডেমিতে আমি ডাক পাই। ক্যানারিওয়ার্ফের হয়ে এখনো আমি অনুশীলন করছি। আমার বেড়ে উঠার পিছনে এয়ারটেল রাইজিং স্টার্স ও ক্যানারিওয়ার্ফের অবদান ভুলার মত নয়।

আমার জীবনের সবচে বড় পরিবর্তনটা আসে বাংলাদেশ জাতীয় অনুর্ধ্ব-১৬ দলে সুযোগ পাওয়ার পর। স্বপ্নের মতই শেষ মুহুর্তে আমি এই সাফ জয়ী দলে যোগ দেই। বিকেএসপিতে দলের ক্যাম্প শুরুর পর হোটেলের উঠার মাত্র দুই দিন আগে আমি দলের সাথে যোগ দেই। অনুর্ধ্ব- ১৬’র জিলানী স্যার, মানিক স্যার যখন আমায় দলে নিলেন তা বিশ্বাসই হচ্ছিলো না। স্যাররাই আমাকে অভয় দিলেন, সাহস দিলেন। দলে সুযোগ পেয়ে বাংলাদেশের কোটি কোটি মানুষের প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ পেলাম। প্রথমে বাংলাদেশ দলের গোলপোস্টে দাড়াতে কিছুটা ভয়ই লাগছিল। এত বড় টুর্ণামেন্ট আগে কখনো খেলা হয়নি। একেতো আমি প্রথম। তারপরও স্বাগতিক দেশ। তার চেয়েও বড় কথা আমার শহর সিলেটে খেলা।

সেখান থেকে আমাদের স্বপ্নের অভিযাত্রা। নিজের শহরে সাফ অনুর্ধ্ব-১৬ চ্যাম্পিয়ানশীপে লাল-সবুজের জার্সি গায়ে খেলেছি এর চেয়ে বড় প্রাপ্তিই আর কিই থাকতে পারে। তার চেয়ে বড় প্রাপ্তিটা হলো আমাদের দলটাই বাংলাদেশের কিশোরদের ইতিহাসে প্রথম সাফ জয়ী দল। আমরা টুর্ণামেন্টের অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন।

সাফ অনুর্ধ্ব-১৬ চ্যাম্পিয়নশিপে সবচে উত্তেজনাকর সময়টা ছিলো ফাইনাল খেলার শেষ মুহুর্তে। যখনি ম্যাচটা ট্রাইব্রেকারে গড়ায়। সব দায়িত্ব এসে পড়লো আমার মত ছোটখাটো এক সাধারণ বালকের উপর। দেশের কোটি কোটি মানুষের আসা-ভরসার স্থল হয়ে দাঁড়ালো বাংলাদেশের গোলবার। যার অতন্দ্রী প্রহরী তখন আমি। টিভি ক্যামেরাগুলো থাক করে আছে গোল বারে। স্টেডিয়াম ভর্তি হাজার হাজারও মানুষ চেয়ে আছেন গোলপোষ্টের দিকে। যেখানে দাঁড়িয়ে আছি কেবল আমি। কি হবে, কি করব তা নিয়েই ছিলাম শঙ্কার মধ্যে। ট্রাইব্রেকারে শেষ সট যখন আমি সেইভ করলাম তখন আমার নিজেরই বিশ্বাস হচ্ছিলো না। মুহুর্তের মধ্যেই আমরা হয়ে গেলাম সাফ চ্যাম্পিয়ন।

সেই আনন্দ আজো মনে অমলিন। আজ তাই স্বপ্ন দেখি আরো বড় ফুটবলার হবার। স্বপ্ন দেখি ফুটবল বিশে^র মানচিত্রে লাল-সবুজের বাংলাদেশকে নিয়ে যাওয়ার।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here