সাগর রায়ঃ জীবন এক রোমাঞ্চের নাম, এই কথাটা বেন স্টোকসের থেকে বিশ্বে আর কেউ বেশি মনে হয় উপলব্ধি করতে পারছে না এই মূহুর্তে! এর পেছনে অবশ্য কারণ আছে। তবে তার জন্য ফিরে যেতে হবে ২০১৬ সালে। মনে আছে সে বছরের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ফাইনালের কথা?
ইংল্যান্ডের বিপক্ষে শেষ ওভারে জয়ের জন্য ক্যারিবিয়ানদের প্রয়োজন ১৯ রান। বল হাতে বেন স্টোকস, আর ব্যাট হাতে স্ট্রাইকিং প্রান্তে উইন্ডিজের কার্লোস ব্র্যাথওয়েট। কলকাতার বিখ্যাত ইডেন গার্ডেন্সে হাজার হাজার দর্শকের মতো টেলিভিশন স্ক্রিনেও বড় একটা অংশ ইংল্যান্ডের নিশ্চিত জয় দেখতে পাচ্ছিল তখন।
কিন্তু দুর্দান্ত, অকল্পনীয়ভাবে টানা চার বলে চার ছক্কা হাঁকিয়ে ম্যাচটাকে বের করে নিয়ে উইন্ডিজের বিশ্বকাপ জয়ের নায়ক বনে গেলেন কার্লোস ব্রাথওয়েট। কমেন্ট্রিতে নিজ দেশের জয় উদযাপন করতে গিয়ে ইয়ান বিশপের মুখে তখন একটাই কথা, ‘কার্লোস ব্রাথওয়েট, রিমেম্যাম্বার দ্য নেইম’। কোটি ক্রিকেটপ্রেমীর কানে আজও বাজে সেই কথা।
সেই ম্যাচে ব্রাথওয়েট নায়ক বনে গেলেও, খলনায়ক বনে গিয়েছিলেন বেন স্টোকস। এই অলরাউন্ডার চার ছক্কা হজম করে তখন মুষড়ে পড়েন ইডেন গার্ডেন্সের বাইশ গজে। বিষাদের বিউগল যখন পুরো ইংলিশ শিবিরে, তখন অশ্রুসজল চোখে ভাষাহীন স্টোকস। বিমূর্ষ আর অবাক চোখে বেদনা সিক্ত তখন তার মন। অনেকেই কটাক্ষ করেন এই ক্রিকেটারকে নিয়ে।
অথচ সেই ছেলেটিই এখন বিশ্বসেরাদের একজন। দমে যাননি স্টোকস। ডানহাতি এই অলরাউন্ডার ফিরেছেন আবারও, কিন্তু ভিন্নভাবে। প্রত্যাবর্তনের মঞ্চে একজন চ্যাম্পিয়ন ক্রিকেটার হয়ে। তাও একবার নয়, বার বার। ২০১৯ ওয়ানডে বিশ্বকাপকেই ধরা যাক। নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ফাইনালে লর্ডসে ৮৪ রানের ইনিংস খেলে রূপকথার মতোন করে দারুণ এক গল্প লেখেন। ওয়ানডেতে প্রথম বিশ্বকাপ এনে দেন ইংল্যান্ডকে। অথচ বিশ্বকাপের আগেও ক্লাবে মারমারি নিয়েও ছিলেন সলোচনায়-বিতর্কে।
২০১৯’র স্টোকস পরিণত হয়েছেন আরও। মাঝে মানসিক অবসাদে হুট করে অনির্দিষ্টকালের বিদায় বলে দেন ক্রিকেটকে। ইনজুরি আরও নানা সমস্যা কাটিয়ে ফিরেছেন। টেস্ট দলের অধিনায়কের দায়িত্ব নিয়ে দলকে ফিরিয়েছেন কক্ষপথে। এখানে আবার একটু পেছনে ফিরলেই না হয়। ওয়ানডে বিশ্বকাপ জয়ের বছরেই হেডিংলিতে অ্যাশেজে বাঁচা-মরার ম্যাচে অবিশ্বাস্য, বীরোচিত এক ইনিংস খেলে দলকে জিতিয়েছিলেন।
৩১ বছরের স্টোকসের জীবনটাই যেন অবিশ্বাস্য সব কীর্তিতে ভরা! ২০১৬ সালের সেই ব্যর্থতার পর ক্যারিয়ারে তার এখন ভরা জোয়ার। সেই অধ্যায়ে এবার নতুন সংযোজন ২০২২ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ। আরও এক ফাইনাল, আরও একবার জয়ের নায়ক স্টোকস। এবার ঐতিহ্যবাহী মেলবোর্ন ক্রিকেট গ্রাউন্ডে পাকিস্তানের বিপক্ষে দ্রুত উইকেট হারিয়ে দল যখন চাপে, তখনই উইকেট আগলে দাঁড়ান স্টোকস। শিরোপা নিশ্চিত করে ছাড়েন মাঠ।
নাসিম শাহ, হারিস রউফদের সামনে নিজের অভিজ্ঞতা নিংড়ে দিয়ে এক প্রান্তে প্রতিরোধ গড়ে তুলে বাঁহাতি এই ব্যাটার খেলেছেন, ৪৯ বলে ৫ বাউন্ডারি ও ১ ছক্কায় ৫১ রানের অপরাজিত এক ইনিংস। যেই ইনিংস টি-টোয়েন্টিসুলভ না হলেও, মাহাত্ম্য অনেক। ইংল্যান্ডকে দ্বিতীয়বারের মতো ক্রিকেটের সবচেয়ে সংক্ষিপ্ত ফরম্যাটের শিরোপার স্পর্শ এনে দেওয়ার ইনিংস এটি। ২০১৬ সালের ফাইনালে শোচনীয় হারের প্রায়শ্চিত্তের ইনিংস। ১৯৯২’র ওয়ানডে বিশ্বকাপ হারের প্রতিশোধের ইনিংস। ব্যর্থতা-হোঁচটে থেমে না গিয়ে সামনে নতুন উদ্যোমে এগিয়ে যাওয়ার ইনিংস এটি।
হয়তো এত কিছু ভাবনা নিয়ে ক্রিকেটটা খেলেন না তিনি। তবুও ইংল্যান্ডের ক্রিকেট ইতিহাসে নিজের নামটা সোনালি অক্ষরে বাঁধিয়ে রাখার জোর দাবি করতেই পারেন স্টোকস। একটি নয়, দুটো আলাদা ফরম্যাটের বিশ্বকাপ জয়ের নায়ক তো আর চাট্টিখানি কথা নয়। শুধুই কী ইংলিশ ক্রিকেট, পুরো ক্রিকেট বিশ্বেই বেনাঞ্জিম অ্যান্ড্রিউ স্টোকস তথা, বেন স্টোকস এক অনুপ্রেরণার নাম এখন। বড় মঞ্চে জ্বলে উঠার নাম।
এসএনপিস্পোর্টসটোয়েন্টিফোরডটকম/নিপ্র/সা